সাক্ষাৎকার

আলোচিত সেই বেলায়েতের গল্প!

মোঃ আনোয়ার সুলতান, নিজস্ব প্রতিবেদক: ৫৫ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আলোচনায় আসা বেলায়েত শেখ আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।

রবিবার (৩১ জুলাই) সকালে সি’ ইউনিটভূক্ত কলা ও মানবিকী অনুষদ এবং বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিউটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি বেলায়েত শেখ। স্বপ্ন তার গনযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার।

এদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসার পথে গতকাল একটি বাসের ধাক্কায় আহত হন তিনি। মেরুদণ্ডের নিচের হাড়ে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় হাটা-চলায় অসুবিধা থাকা সত্বেও আজ ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি।

ঢাকা অর্থনীতির সাক্ষাৎকরে তুলে ধরেন তার অদম্য মনোবলের গল্প।

বেলায়েত শেখ বলেন, ‘২০১৭-তে বাঁধা তার বাঁধার মধ্যে পাশ করছি। ২০২১ ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিবো গাড়ি ফেল করছি। পরে পাঁচল্লিশ মিনিট লেট আমাকে ঢুকবার দেয় না। পরে আমি জোড় হাত ধইরা কান্না কইরা দিছি পরে দারোয়ান প্রিন্সিপাল সারের সাথে কথা বইলা আমারে সুযোগ দিছে। ওইখানে গেছি ছয়তালাত গেছি একটা দৌড়ে। দুই দিনের না খাওয়া। পরে খাবার সুযোগ পাইছি না ওইখানে গিয়া পরীক্ষা দিছি তারপর সাতত্রীশের মধ্যে সাতাশ এ্যান্সার করছি। ওইখানে এ্যাক্সিমিনার যারা আছে ওনারা বলছে আপনে কি পাশ করবেন? আমি বললাম সার পাশের আশাতো আমি করি না। তো কিসের আশা? আমি কই সার এ-প্লাসে’র (A+) আশা। আমার কথা আমার ছেলে মেয়ের চেয়ে ভালো রেজাল্ট থাকতে অইবো। আর আমি রাইত কইরা বেশি পড়ি। তবে আমার ছুট ছেলের চেয়ে আমার রেজাল্ট ভালো, বড় ছেলের চেয়ে রেজাল্ট ভালো, মেয়ের চেয়ে ভালো, আমার ছেলে মেয়েরাতো আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তো এ্যাপলাই করার ক্ষমতা নাই। তা আমি করছি, পরীক্ষাও দিছি আরেকটা হইছে চট্রগ্রাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মনে করেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনেগো যে ভালোবাসা পাইছি তার চেয়ে বেশি ভালোবাসা পাইছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহীতে আমার আসবার মনে চাইনা মনে করেন এতো ভালো লাগছে। ভিসি সার এতো সুন্দর বক্তব্য দিছে যেটা সারকে ভালো লাগছে। এখনতো আমিতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আশার সময় সাররে সালাম দিয়া আসছি। সারেরা বলছে যাক দিছেন তো? আমি বললাম সার দিছি চেষ্টা করতাছি বাকিটা পরে বললো হ ধন্যবাদ, ধন্যবাদ জানাইছে। সর্বোপরি পরীক্ষা দিয়েছি, দুঃখ কষ্টের মাঝে পরীক্ষা দিয়েছি পাশটা তো পরে কারণ প্রতিযোগিতায় টিকতে হবে আল্লাহ দয়া করলে হইতেও পারে। এরপর চট্টগ্রামে পরীক্ষা দিবো।’

এর আগে গতকাল শনিবার (৩০ জুলাই) সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন বেলায়েত শেখ। তিনি বলেন, ‘কালকে আসার পথে ঢাকা-ময়মনসিংহগামী একটি বাসের বেপরোয়া চালানির পথে পরে আমি সিটে বসাকালীন আমি মেরুদণ্ডের নিচে ব্যথা পাইছি। এতে আমার সতের ঘন্টা পায়খানা প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেছিলোগা। আমার এক বন্ধু সাংবাদিক আতিয়ার সাহেবের বাসায় আসছি। উনি প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পরে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়া গেছে। ওইখান থেকে চিকিৎসা হওয়ার পর ওনার সেবায় ডাক্তারের সেবায় মুটামুটি প্রস্রাবটা ক্লিয়ার হচ্ছে কিন্তু পায়খানাটা ক্লিয়ার হচ্ছে না বড় ডাক্তার দেখাতে হবে। আর আমার বাড়ির পরিবার থেকেই বলছিলো পরীক্ষা দেওয়া লাগবে না বাড়িতে চইলা যাওয়ার জন্য। তা আমি বলছি যে আমার মৃত্যু হয় পরীক্ষা হলে হইলেও আমার দুঃখ নাই। আমি পরীক্ষা দিয়া যামু। তো পরীক্ষা দিছি পঞ্চাশের উপরে এ্যান্সার দিছি। যেহেতু পাশ করে হবে না, প্রতিযোগীতায় টিকতে হইবো। একজন সাংবাদিক ভাই বললো আপনের এখানে কারিগরি ভোকেশনাল এটা হলো ভাগ করা সিট। তো ওই ভাগ করা সিট হিসাবে আশা করা যায় আরকি। এমনে পাশ করলে তো আর প্রতিযোগীতায় টিকবো না জেনারেল যেসব ছেলে মেয়ে আছে ইয়াং ছেলে মেয়ে আছে তাদের সাথে প্রতিযোগীতায় আমার টেকাটা কষ্টকর। যেখানে আমার এখানে ভাগ করা আছে সেই হিসাবে আমার মনে হয়তো সুযোগ হইতেও পারে মানে একটু আশা করতে পারি। কারিগরি দুই-চার দশহাজার শিক্ষার্থীর সাথে পরীক্ষা দিলে পাশ করবো। জেনারেলের লগে পারবো না, জেনারেলের তারা মেধার উচ্চ লেবেলে তারা। জেনারেলের সাথে পরীক্ষা দিলে কমপিটিশন টিকাটা খুব কষ্টকর। কারিগরির সাথে পারবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা জানেন ছোট বেলা থেকে লেখাপড়া করতে গেলে খালি বাধা আসে। সব বাধা পেড়িয়ে ৮৩ সালে ছিলাম বাধা, ৮৮ সালে বাধা, ৯১ সালে বাধা পরে ২০১৭ তে বাধা, বাধার মধ্যেই পাশ করছি।’

২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে প্রবীণতম শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন বেলায়েত৷ তিনি ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন৷ যদিও এখনো তিনি কোথাও পড়ার সুযোগ পাননি৷

গাজীপুরের মাওনার বাসিন্দা বেলায়েত শেখ ১৯৮৩ সালে মাধ্যমিক (এসএসসি) পরীক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু বাবার অসুস্থতার কারণে পড়াশোনা ছেড়ে তিনি পরিবারের হাল ধরেন। এ কারণে তাঁকে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হয় তার৷ পরে নিজের অসমাপ্ত স্বপ্নপূরণে ভাই ও সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করার চেষ্টা করেন বেলায়েত শেখ৷ কিন্তু তাঁদের কেউই তাতে সফল হননি৷

শেষ পর্যন্ত ৫০ বছরে পা দিয়ে বেলায়েত শেখ নিজেই ভর্তি হন নবম শ্রেণিতে৷ এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে (এইচএসসি) উত্তীর্ণ হওয়ার পর ৫৫ বছর বয়সে এবার তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন৷

বেলায়েত দৈনিক করতোয়া পত্রিকার গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন৷

/এএস

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close