করোনাদেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম
আম্পানের পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা উপকূলবাসীর
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করেই টিকে থাকতে হয় উপকূলবাসীর। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস তাদের নিত্যসঙ্গী। ঘূর্ণিঝড় আম্পান তাদের সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, ক্ষেতের ফসল, মাছ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি হারিয়ে আজ নিঃস্ব তারা। এই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সংগ্রামে নেমেছেন উপকূলের মানুষ। ঘরদোর মেরামত, ফসলের ক্ষেত পরিচর্যাসহ জীবিকার সন্ধানে ছুটছেন তারা।
সাতক্ষীরা :সদর উপজেলার ভোমরাসহ বিভিন্ন স্থানে বিধ্বস্ত হওয়া পরিবারের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ত্রাণ সহায়তা- পরিবারপ্রতি দুই বান্ডেল করে ঢেউটিন টিন, নগদ তিন হাজার টাকা ও খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়েছে। মারা যাওয়া দুই ব্যক্তির পরিবারকেও ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরা সদর-২ আসনের এমপি মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি এ সহায়তা পৌঁছে দেন। তার সঙ্গে ছিলেন জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেবাশীষ চৌধুরী। এদিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করে দ্রুত এগুলো মেরামত করতে সংশ্নিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার।
জয়পুরহাট :আম্পানের আঘাতে জেলার কালাইয়ে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়োবাতাস ও ভারি বর্ষণে কাঁচা-পাকা ধানের গাছ জমিতে হেলে মাটির সঙ্গে লেগে আছে। কৃষকরা মাঠে নেমে গাছগুলো থেকে ধান রক্ষার চেষ্টা করছেন।
উপজেলার মাদাই গ্রামের আফজাল হোসেন জানান, এবার তিনি ১৮ বিঘা জমিতে ধানচাষ করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছিল। ধানও কাটার উপযোগী হয়ে গেছে, এমন সময় আম্পান এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। অবশিষ্ট কিছু পাওয়া যায় কিনা এ জন্য জমিতে নেমে পরিচর্যা শুরু করেছেন।
সুড়াইল গ্রামের বর্গাচাষি যোবাইল ইসলাম জানান, ধানচাষ করেই সংসার চলে তার। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে তার আট বিঘা জমির প্রায় সব ধান ক্ষেতে পড়ে গেছে। ধানগাছ মাটিতে পড়ে যাওয়ায় কৃষি শ্রমিকরা ধান কাটা ও মাড়াই করতে চাচ্ছেন না। বেশি টাকা দাবি করছেন তারা।
কালাই উপজেলার ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, আম্পানের প্রভাবে প্রায় এক হাজার ৩০০ হেক্টর জমির কাঁচা-পাকা ধানের গাছ হেলে পড়েছে। তবে ধানের তেমন ক্ষতি হবে না। আবহাওয়া ভালো হলেই জমি থেকে পানি নেমে যাবে।
পঞ্চগড় :ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি বাড়ি নতুন করে নির্মাণ করে দিল সেনাবাহিনীর একটি দল। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল সেনাবাহিনীর রংপুর অঞ্চলের উদ্যোগে ঘর নির্মাণ ও মেরামতের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকার ৯টি এতিমখানার শিশু, ঝড়-করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কর্মহীন মানুষ, প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রীদের ঈদ উপহার প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের ২৯ বীর ব্যাটালিয়নের মেজর তৌহিদুল বারী পঞ্চগড় সদরের তিনটি এতিমখানায় এবং লেফটেন্যান্ট ইনজামামুল আমীন প্রীমন দেবীগঞ্জ উপজেলার ছয়টি এতিমখানার ১৪৭ জন এতিম ও দুস্থ শিশুর মাঝে ঈদ উপহার হিসেবে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেন। প্রতিটি প্যাকেটে উপহার হিসেবে ছিল পোলাও চাল, সেমাই, গুঁড়ো দুধ, সয়াবিন তেল, মুরগির মাংস ও ডিম। একই সঙ্গে জেলায় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের দেওয়া এবং সেনাবাহিনীর নিজস্ব তহবিলে একশ’ জনের মাঝে এই ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর লেডিস ক্লাবের পক্ষ থেকে জেলার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের ৫০ জন বিধবাকে ঈদ উপহার প্রদান করা হয়।
নোয়াখালী :সুবর্ণচর ও হাতিয়া উপজেলায় ত্রাণ এবং চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। গতকাল দিনব্যাপী কুমিল্লা সেনানিবাসের মেজর কামরুল আহসানের নেতৃত্বে সেনা সদস্যরা এসব সহায়তা পৌঁছে দেন। এ সময় বয়ারচরে ক্ষতিগ্রস্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, ঘূর্ণিঝড়ে পড়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি ঘরও মেরামত করে দেন সেনা সদস্যরা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ক্যাপ্টেন আশরাফুল ও লেফটেন্যান্ট সাখাওয়াত।
মোংলা (বাগেরহাট) : মোংলা বন্দরের মালামাল ওঠানামার কাজসহ সব অপারেশন কাজ পুনরায় শুরু হয়েছে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া বন্দরের অপারেশন কাজ গতকাল সকাল থেকে পুরোদমে শুরু করা হয়েছে। বন্দর জেটি ও চ্যানেলে অবস্থানরত ১৩টি বাণিজ্যিক জাহাজ থেকে যথারীতি পণ্য ওঠানামার কাজ চলছে।
গোপালগঞ্জ :আম্পানের প্রভাবে জেলায় অন্তত দুই হাজার ৪০০ হেক্টর জমির পাকা বোরো ধান তলিয়ে গেছে। সদর উপজেলার করপাড়া ইউনিয়নের বলাকইড় গ্রামের শাহজাহান মিয়া বলেন, আমাদের গ্রামের অন্তত ৫ একর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এ ধানে গাছ গজিয়ে গেছে। জমি থেকে ধান কাটা গেলেও নষ্ট এ ধান কোনো কাজে আসবে না।
নিজড়া গ্রামের কৃষক আল-আমিন মিনা বলেন, আমাদের নিচু এলাকার অন্তত ৫ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এ ধান কেটে জমি থেকে ওঠানো হচ্ছে। দু’দিন ভালোভাবে রোদ হলে ধান নষ্ট হবে না বলে জানান তিনি।
কাঁঠালিয়া (ঝালকাঠি) : আম্পানের তাণ্ডবে বিষখালী নদীর বেড়িবাঁধ, কাঁচা রাস্তা, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির, গাছপালা, হাস-মুরগিসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে উপজেলার ১৪ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে মাছের ঘের ও ছোট-বড় পুকুর। ভেসে গেছে জেলেদের নৌকা। তবে থেমে থাকেনি এখানকার মানুষ। নতুন উদ্যমে আবারও কাজে নেমে পড়েছেন তারা। এদিকে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক মনির এবং ইউএনও আকন্দ মোহাম্মদ ফায়সাল উদ্দীন ভাঙন স্থান পরিদর্শন করেছেন।
নাজিরপুর (পিরোজপুর) :উপজেলার অধিকাংশ মৎস্য ও হাঁস-মুরগির খামার পানিতে ডুবে গেছে। দেউলবাড়ী ইউনিয়নের বিল ডমুরিয়া গ্রামের কামাল ফকির জানান, বুধবার রাত ১০টার দিকে মাছ ও মুরগির খামার পানিতে তলিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও তিনি মুরগি বাঁচাতে পারেনি। তার প্রায় এক হাজার মুরগি মারা যায় এবং ঘেরের সব মাছ বের হয়ে যায়। সব মিলিয়ে তার ক্ষতি প্রায় ৫ লাখ টাকা।
মিজান গাজী জানান, দশ বিঘা জমির ওপর তিনি মাছ ও মুরগির খামার করেছিলেন। ঘেরের প্রতিটি মাছ দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের হয়েছিল। ঘেরের মাছ বের হয়ে গেছে। এ ছাড়া ৫-৬শ’ মুরগি মারা গেছে। সব মিলিয়ে তিনি প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
উপজেলার কলারদোয়ানিয়া গ্রামের মৎস্যচাষি ফিরোজ মাহমুদ জানান, ওই রাতে তার মাছের ঘের পানিতে ডুবতে থাকলে চোখের সামনেই ঘেরের মাছ বের হতে থাকে, অনেক চেষ্টা করেও তা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
মালিকালী ইউনিয়নের পেনাখালী গ্রামের মৎস্যচাষি টিপু সুলতান জানান, তার ৮০ একর জমিতে থাকা মাছের ঘের ভেসে গিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
/আরএম