দেশজুড়ে

আবার বন্ধ হলো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: আজ শুক্রবার রাতেই শেষ হয়ে যাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী ভিসায় যাওয়ার সময়। দেশটির সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজই দেশটিতে কর্মীদের যাওয়ার শেষ সুযোগ। আগামীকাল শনিবার থেকে আর কোনো কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন না। এ কারণে বাংলাদেশের অনুমোদনকৃত ৩১ হাজার ৭০১ জন কর্মীর মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে।

বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, গত ২১ মে পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৪ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেয়। ২১ মের পর আর অনুমোদন দেওয়ার কথা না থাকলেও বিএমইটির তথ্য বলছে, মন্ত্রণালয় আরো এক হাজার ১১২ জন কর্মীকে দেশটিতে যাওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। অর্থাৎ গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাঁচ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে চার লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তথ্য বলছে, আজ বাংলাদেশ থেকে মাত্র এক হাজার ৫০০ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন। অর্থাৎ অনুমোদনকৃত ৩১ হাজার ৭০১ জন কর্মীর যাত্রা বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

কুয়ালালামপুরের দুটি আন্তর্জাতিক বিমান টার্মিনালের ফ্লোরে গতকাল পর্যন্ত ১৪টি দেশ থেকে আসা প্রায় ২০ হাজার কর্মী অবস্থান করছিলেন। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার কর্মী বাংলাদেশের।

শেষ মুহূর্তে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে কর্মীর উপচে পড়া ভিড় তৈরি হয়েছে। এতে দুর্ভোগ বাড়ছে কর্মী ও নিয়োগকর্তাদের। নিজেদের কর্মী শনাক্তে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নিয়োগকর্তাদের।

কর্মীরা বলছেন, তাঁরা তিন-চার দিন ধরে বিমানবন্দরে অবস্থান করছেন। কেউ নিয়োগকর্তার খোঁজ পাচ্ছেন, আবার কেউ পাচ্ছেন না।

নিয়োগকর্তারা তাঁদের শুধু অপেক্ষা করতে বলছেন। অনেকে বলছেন, নিয়োগকর্তা তাঁদের না নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন।
কর্মীদের এসব অভিযোগ নিয়ে নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কর্মীদের ফিরে যাওয়ার কথা বলিনি। তবে অতিরিক্ত চাপ পড়ায় তাঁদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে সময় প্রয়োজন।’

প্রবাসী কর্মীদের এই বিশাল চাপ সামলাতে দেশটির অভিবাসন বিভাগ থেকে নিয়োগকর্তাদের জন্য কর্মী খোঁজার সময়সূচি নির্ধারণ করে দিয়েছে।

অভিবাসন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, পরিস্থিতি মোকাবেলায় অতিরিক্ত কাউন্টার খোলা হয়েছে এবং অভিবাসন কর্মকর্তার সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। বিদেশি কর্মীদের জন্য পানি ও খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তথ্য বলছে, আজ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সাতটি ফ্লাইট মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। এর মধ্যে বিমান বাংলাদেশের দুটি, ইউএস-বাংলার দুটি, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের একটি, এয়ার এশিয়ার একটি এবং বাতিক এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট মালয়েশিয়ায় যাবে।

বাড়তি দামে টিকিট বিক্রির অভিযোগ

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধের সময় ঘনিয়ে আসায় বাড়তি দামে টিকিট বিক্রির অভিযোগ করেছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। বিমান বাংলাদেশের বিশেষ ফ্লাইটের টিকিটের দামও এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে গত রবিবার বিমানের টিকিট বাণিজ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ করেন ফারিয়েল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইথার ফারিয়েল হামিদ। তাঁর অভিযোগে বলা হয়, মালয়েশিয়া যেতে বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে সরাসরি টিকিট করতে পারছে না এজেন্সিগুলো। গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে (জিডিএস) ফ্লাইটের টিকিট দেখাচ্ছে না। এই সুযোগে বিমানের কর্মকর্তারা দুর্নীতি করছেন। এতে টিকিটের দাম এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

দুর্নীতির বিষয়ে জাতিসংঘের চিঠি

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগপ্রক্রিয়ার দুর্নীতি নিয়ে গত ২৮ মার্চ মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দেয় জাতিসংঘের চারজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ। তবে দুই দেশের সরকারই এই চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

গত রবিবার জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর) এই চিঠি প্রকাশ করেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ টোমোয়া ওবোকাটা, রবার্ট ম্যাককরকোডালে, গেহাদ মাদি ও সিওবান মুল্লালি এই চিঠি দেন।

চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশি কর্মীদের জনপ্রতি সাড়ে চার থেকে ছয় হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়োগ ফি দিতে হচ্ছে, যা ২০২১ সালে এই দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) খেলাপ। ওই এমওইউ অনুযায়ী, এই ফি হবে ৭২০ ডলার পর্যন্ত। বাংলাদেশি প্রবাসীরা বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ নিয়োগ ফি প্রদান করে থাকেন, যা বাজারের প্রচলিত হারের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় একটি অপরাধী নেটওয়ার্ক কাজ করে। তারা কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করে এবং ভুয়া কম্পানিতে নিয়োগ দেয়। এই নিয়োগের সঙ্গে জড়িত নিয়োগকর্তা, এজেন্ট ও সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহির অভাব রয়েছে।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উভয় সরকারের কাছে এ বিষয়ে তদন্ত, অপরাধীদের বিচার এবং নৈতিক নিয়োগের নীতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন। তবে ৬০ দিনের মধ্যে কোনো সরকার থেকে জবাব না আসায় এই চিঠি মানবাধিকার কাউন্সিলে উপস্থাপন করা হবে বলে জানানো হয়।

চলতি বছর কর্মী যাওয়ার সম্ভাবনা নেই

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ইস্যুতে গত ২০ মে সংবাদ সম্মেলন করেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইল এবং মানবসম্পদমন্ত্রী স্টিভেন সিম চি কিয়ং। সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইল বলেন, ‘মালয়েশিয়া সরকার আর বিদেশি কর্মীদের আবেদন গ্রহণ করবে না। বিদেশি কর্মীদের আবেদন বর্তমানে স্থগিত থাকছে।’

আটকে থাকা কর্মীদের বিষয় কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের সভাপতি আবুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে একাধিকবার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমরা দু-এক মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলাম। তাহলে সব কর্মীকে পাঠানো যেত। কারণ কর্মীরা যেতে না পারলে তাদের আর্থিক ক্ষতি হবে। তারা অনেক টাকা দিয়ে বসে আছে। আজও (বৃহস্পতিবার) এই বিষয় মন্ত্রণালয়কে অবগত করেছি। কাল (শুক্রবার) মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে একটি বৈঠক রয়েছে। বৈঠকের পর জানা যাবে বিষয়টির কী হবে।’

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (কর্মসংস্থান) গাজী মো. শাহেদ আনোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ বিষয় আন্ত মন্ত্রণালয়ের বৈঠক চলছে। সামনেও বৈঠক হবে। এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close