আমদানি-রপ্তানীপ্রধান শিরোনামশিল্প-বানিজ্য

সম্পত্তি ভাগ করে নিচ্ছেন আকিজ উদ্দিনের ছেলেরা, ছোট হচ্ছে আকিজ গ্রুপ

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ আকিজ গ্রুপ দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান। ১৯৪০ সালে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল একজন সাধারণ বিড়ি ব্যবসায়ী শেখ আকিজ উদ্দিনের হাত ধরে। পাটের ব্যবসা দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে সিমেন্ট, সিরামিকসহ ২১টি খাতে গড়ে তোলা হয়েছে নানা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান।

আকিজ উদ্দিনের উদ্যোগগুলো যাতে তার উত্তরসূরিদের হাতে আরও প্রসারিত হতে পারে, সেজন্য নিজে স্বল্পশিক্ষিত হয়েও সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করেছেন তিনি। তার ১০ ছেলেকেই পারিবারিক এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন। ছেলেরাও এখন তাদের বাবার দেখানো পথেই হাঁটছেন। জানা গেছে, আকিজ উদ্দিনের পাঁচ ছেলে বর্তমানে আকিজ গ্রুপ পরিচালনা করছেন। অপর পাঁচ ছেলে এই গ্রুপের বাইরে নিজেরাই আলাদা আলাদা নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

আকিজ গ্রুপের ওয়েবসাইট মতেও, কেবল পাঁচ জনই আকিজ গ্রুপের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন। মৃত্যুর আগে আকিজ উদ্দিন নিজেই সব সম্পদ ছেলেদের মাঝে ভাগ করে দিয়ে যান। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই গ্রুপের দুই ডজন শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফের আকিজ উদ্দিনের পাঁচ ছেলের মধ্যে ভাগবণ্টন হতে যাচ্ছে। এ নিয়ে গ্রুপের লিগ্যাল অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগ কাজ করছে। খুব শিগগিরই যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয়ের (আরজেএসসি) মাধ্যমে এ ভাগবণ্টন চূড়ান্ত হবে। করোনা মহামারির মাঝেই নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাগাভাগি করে নেওয়ার বিষয়ে পাঁচ ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

উল্লেখ্য, শেখ আকিজ উদ্দিনের মেজো ছেলে চামড়া শিল্প প্রতিষ্ঠান এসএএফ লেদার ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মমিন উদ্দিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ আগস্ট মারা গেছেন।

আকিজ গ্রুপের মূল অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন পাঁচ ভাই—শেখ বশির উদ্দিন, শেখ জামিল উদ্দিন, শেখ জসিম উদ্দিন, শেখ শামীম উদ্দিন ও শেখ নাসির উদ্দিন। গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে আছেন শেখ নাসির উদ্দিন। শেখ বশির উদ্দিন আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন।

অন্যদিকে পারিবারিক যৌথ প্রতিষ্ঠানের বাইরে আলাদা প্রতিষ্ঠান করে আকিজের আরেক ছেলে শেখ আফিল উদ্দিন এখন দেশের একজন সফল উদ্যোক্তা। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি ‘আফিল গ্রুপ’। রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত আছেন আফিল উদ্দিন। তিনি যশোর- ১ (শার্শা) আসনের সংসদ সদস্য। আফিল গ্রুপের বর্তমানে ২৭টি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাবার হাত ধরেই তিনি ২০০০ সালের দিকে আলাদা ব্যবসা শুরু করেন। কৃষি খাতের পাশাপাশি জুটমিল, পেপার মিল, পোলট্রি, ব্রিকস, ফিড মিলসসহ অনেক ভারি শিল্পও আছে এ গ্রুপের। এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কাজ করছেন প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এছাড়া, আদ-দ্বীনের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে রয়েছেন বড় ভাই ডা. শেখ মহিউদ্দিন। অন্য সন্তানদের মধ্যে করোনায় মারা যাওয়া শেখ মমিন উদ্দিন পৈতৃক সূত্রে আকিজ গ্রুপ থেকে দুটি প্রতিষ্ঠান পেয়েছিলেন। একটি আকিজ ফুটওয়্যার, অন্যটি এসএএফ লেদার। দুই প্রতিষ্ঠানেরই তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। এছাড়া শেখ আজিজ উদ্দিন ও শেখ আমিন উদ্দিন একাধিক প্রতিষ্ঠানের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

জানা গেছে, ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর ৭৭ বছর বয়সে আকিজ উদ্দিন মারা যাওয়ার পর আকিজ গ্রুপে যুক্ত হয়েছে আরও কয়েকটি নতুন প্রতিষ্ঠান।

আকিজ গ্রুপের এমডি শেখ বশির উদ্দিন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আকিজ একটি পুরনো ডায়নামিক গ্রুপ। এই গ্রুপের পরিধি ও বিস্তৃতি আগের চেয়েও বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তার ভাইয়েরাও আলাদাভাবে ব্যবসা করছেন। আলাদা গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের ব্যবসার পরিধিও বেড়েছে।’ তিনি জানান, এতে আকিজ গ্রুপের কোনও ক্ষতি হয়নি। কারণ, তাদের কেউই আকিজ গ্রুপ ভেঙে অথবা আকিজ গ্রুপ থেকে বের হয়ে যাননি। ফলে আকিজ গ্রুপ আগের মতোই আকিজ গ্রুপই আছে।

দেশে পাট ও বেভারেজ খাতের নেতৃত্বে রয়েছে আকিজ গ্রুপ। দেশের সবচেয়ে বড় জুটমিলটিও এখন আকিজের।

ব্যবসা সম্প্রসারণের ধারাবাহিকতায় আকিজের পাঁচ ছেলে তথা পাঁচ শিল্প উদ্যোক্তা দিলকুশার ‘আকিজ চেম্বার’ ছেড়ে রাজধানীর তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোডে ‘আকিজ হাউস’ নামে নতুন কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তার অন্য ছেলেরা এখনও দিলকুশার আকিজ চেম্বারেই রয়েছেন।

বর্তমানে পাঁচ ভাইয়ের নেতৃত্বে রয়েছে ২৪টির মতো বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—আকিজ জুটমিলস লিমিটেড, আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, আকিজ সিরামিকস, আকিজ সিমেন্ট, আকিজ টেক্সটাইল মিলস, আকিজ প্লাস্টিকস, আকিজ শিপিং লাইন, আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলস, আকিজ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজেস, আকিজ ফ্লাওয়ার মিলস, আকিজ পলি ফাইবার ইন্ডাস্ট্রিজ, আকিজ অ্যাগ্রো প্রসেসিং ফ্যাক্টরি, বাহাদুরপুর টি এস্টেট, আকিজ বায়াক্স ফিল্মস, আকিজ সেন্ট্রাল ওয়ার্কশপ, আকিজ স্টিল মিলস, আকিজ সিটি সেন্টার, রবিন এমডিএফ, আকিজ বেকার্স ও আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরি লিমিটেড।

জানা গেছে, আকিজ গ্রুপের উত্থান মূলত বিড়ি শিল্প দিয়েই। পঞ্চাশের দশকে বিড়ির ব্যবসা শুরু করে ধীরে ধীরে অন্যান্য খাতেও মনোযোগ দেন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আকিজ উদ্দিন।

তামাকজাত পণ্যের মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণ হলেও বর্তমানে ঢাকা টোব্যাকোর মালিকানা আকিজ গ্রুপের হাতে নেই। ২০১৮ সালের আগস্টে ‘জাপান টোব্যাকো’ আকিজের ‘ঢাকা টোব্যাকো’ কিনে নেয়। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি হয় ১৫০ কোটি ডলারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা।

এছাড়া, আকিজ গ্রুপের বাইরে হলেও আকিজ উদ্দিনের সন্তানদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে—আকিজ রাইস ইন্ডাস্ট্রিজ, আকিজ জর্দা ফ্যাক্টরি, আকিজ ওয়াইল্ডলাইফ ফার্ম, আকিজ সিকিউরিটিজ, আকিজ মোটরস, আকিজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, আকিজ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস, আকিজ গ্যাস স্টেশন, আকিজ গ্যাস কোম্পানি, আকিজ করপোরেশন, আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি, আকিজ অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রি, আবরার ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস ও আকিজ ক্যাবলস।

জানা গেছে, ১৯৬০ সালে যশোরের অভয় নগরে শেখ আকিজ উদ্দিন গড়ে তোলেন অত্যাধুনিক চামড়া কারখানা এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ। এরপর ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ, ১৯৭৪ সালে আকিজ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, ১৯৮০ সালে আকিজ ট্রান্সপোর্টিং এজেন্সি লিমিটেড ও ১৯৮৬ সালে জেস ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। নব্বইয়ের দশকে অর্থাৎ ১৯৯২ সালে গ্রুপটির অধীন গড়ে ওঠে আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরি লিমিটেড, ১৯৯৪ সালে আকিজ জুটমিল লিমিটেড, ১৯৯৫ সালে আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড ও আকিজ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড। এছাড়া ১৯৯৬ সালে গড়ে তোলা হয় আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলস লিমিটেড, ১৯৯৭ সালে আকিজ হাউজিং লিমিটেড ও ১৯৯৮ সালে সাভার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড গড়ে ওঠে ২০০০ সালে। একই বছর চালু হয় আকিজ অনলাইন লিমিটেড ও নেবুলা লিমিটেড। আর ২০০১ সালে গড়ে তোলা হয় আকিজ করপোরেশন লিমিটেড ও আকিজ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড টেকনোলজি লিমিটেড।

আকিজ গ্রুপ বর্তমানে দেশের অন্যতম শীর্ষ করপোরেট প্রতিষ্ঠান হলেও শুরুটা খুব সহজ ছিল না। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই ১৯৪২ সালে নিজ গ্রাম খুলনার ফুলতলার মধ্যডাঙ্গা ছেড়ে জীবিকার অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েন শেখ আকিজ উদ্দিন। মাত্র ১৬ টাকা মূলধন নিয়ে কলকাতায় পাইকারি বাজার থেকে কমলা লেবু কিনে হাওড়া ব্রিজে ফেরি করতেন তিনি। বলা যায়, সেটাই ছিল আকিজ গ্রুপের ব্যবসার প্রাথমিক সূচনা।

/আরএম

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close